সোমবার, ৩ অক্টোবর, ২০১৬

ভালোবাসার সুতোয় গাঁথি সম্পর্কের মোতি...২






ছুটতে ছুটতে রান্নাঘরে ঢুকে স্বস্থির নিশ্বাস ফেললো নূহা রাহাতকে ফিরনী নাড়তে দেখে। রাহাতের পাশে জারিফ দাঁড়িয়ে ছিল। নূহা ঢুকতেই পিতা-পুত্র দুজনই একসাথে নূহার দিকে তাকিয়ে, 'এ আর নতুন কি' স্টাইলের একটা হাসি দিলো। তবে জারিফ বাবার চেয়ে দু'কদম এগিয়ে সবসময়ই। সে বুড়া দাদার স্টাইলে মাথা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বলল, ওহো মা তোমার যে কি হবে সবকিছু শুধু ভুলে যাও। অন্তত আমাকে বা বাবাকে বলেও তো দিতে পারো খেয়াল রাখার কথা। যদি আমার রুমের পানি শেষ হয়ে না যেত, যদি আমি পানি নিতে কিচেনে না আসতাম তাহলে তো বাবাকে ডেকে আনতে পারতাম না। এবং সব ফিরনী পুড়ে যেতো। তখন কি হতো?
নূহার ইচ্ছে করছিল বলে, তখন পুড়ে যাওয়া ফিরনী তোকে আর তোর বাবাকে চেপে ধরে খাওয়াতাম দুষ্টু ছেলে। কিন্তু লিখিত সব চিঠি যেমন পোষ্ট করা হয় না, লেখার পরেও কিছু টেক্সট সেন্ড করা হয় না। তেমনি মুখে চলে আসা সব কথাও বলতে হয়না। সেগুলোকে ভেতরের দিকে ঠেলে দিয়ে ভিন্ন কিছু বলতে হয়। নূহাও তাই বলতে ইচ্ছে করা কথাগুলো সজোরে ভেতরে ঠেলে দিয়ে হাসি মুখে বলল, জাযাকাল্লাহ বাব্বু সোনা। তুমি আর তোমার বাবা না থাকলে আমার যে কি হতো ভেবে পাইনা।
রাহাত হেসে বলল, জারিফ মাকে বলো কিছুই হতো না, শুধু আজ ফিরনীটা পুড়ে যেতো।
রাহাত আর জারিফের সাথে হাসিতে নূহাও যোগ দিলো। হাসতে হাসতেই পানির বটল হাতে নিয়ে বাবা-মার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নিজের রুমে চলে গেলো জারিফ। জারিফ চলে যাওয়া মাত্রই নূহার চেহারা চেঞ্জ হয়ে গেলো। চোখ নাক মুখ কুঁচকে বলল, সুযোগ পেলেই যে আপনারা পিতা-পুত্র মিলে আমাকে যন্ত্রণা করেন। এইসব কিন্তু সহ্য করা হবে না বলে দিচ্ছি। কঠিন শিক্ষা দেয়া হবে দুজনকেই। বিশেষ করে পুত্রকে। সে অতিমাত্রায় পন্ডিত হয়েছে।
রাহাত হাসতে হাসতে বলল, তোমার যত শিক্ষা দেবার আমাকে দাও। কিন্তু আমার পুত্রকে কিছু বলো না। পুত্রটা আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের বিশেষ রহমত হয়ে এসেছে আমার জন্য। তুমিই চিন্তা করে দেখো পুত্র না থাকলে কি আমি সকাল বিকাল বৌয়ের মুখে লাভ ইউ শুনতে পেতাম?
লাজুকতা মেশানো হাসি ফুটে উঠলো নূহার চেহারাতে। মনে পরে গেলো বেশ কয়েক মাস আগে জারিফের ছুটির এক সকালে রাহাত নাস্তা করে যখন ডিউটিতে যাচ্ছিলো সবসময়ের মতো নূহা সালাম এবং ফী আমানিল্লাহ বলে বিদায় জানিয়েছিল রাহাতকে। জারিফ পাশেই বসে খেলছিল। হঠাৎ বলে উঠেছিল, মা তুমি শুধু সালাম আর ফী আমানিল্লাহ বলছো কেন? আর কিছু বলবে না বাবাকে? নূহা বেশ অবাক হয়ে প্রশ্ন করেছিল, আর কি বলবো? জারিফ জবাবে বলেছিল, তুমি চিন্তা করে দেখো আর কি বলতে হয় বিদায়ের সময়। নূহা তখন বুঝে নিয়েছিল জারিফ কি বলতে চাইছে। কারণ জারিফ স্কুলে বা বাইরে কোথাও যাবার সময় বিদায় দেবার সময় নূহা সালাম ছাড়াও সবসময়ই লাভ ইউ এন্ড মিস ইউ বাক্য দুটোও বলে। তার বাবাকেও কেন বাক্য দুটা বলা হচ্ছে না সেটাই জারিফের প্রশ্ন ছিল।) পুত্র কি মিন করছে সেটা বুঝতে পেরে হেসে ফেলেছিল নূহা। কিন্তু সেই হাসিতে দমে যাবার ছেলে জারিফ না। সে ঘ্যানঘ্যান করতে শুরু করে দিয়েছিল, মা বাবাকে বলো। মা বাবাকে বলছো না কেন? তাড়াতাড়ি বলো বাবার দেরি হয়ে যাচ্ছে তো! পুত্রের অস্থিরতা দেখে নূহা লজ্জা মেশানো স্বরে লাভ ইউ এন্ড মিস ইউ বলেছিল রাহাতকে। জারিফ তখন উচ্ছ্বাসিত কন্ঠে বলেছিল, এই তো এবার হয়েছে। এখন থেকে সবসময় এভাবে বিদায় দেবে বাবাকে। জারিফের খুশির জন্য বলতে বলতে এখন যদিও অভ্যাস হয়ে গিয়েছে কিন্তু সেদিনের কথা মনে পড়লো এখনো লাজুকতার আবেশ ছড়িয়ে যায় মনে। রাহাতকে কৌতুক ভরা চোখে তার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে হাত বাড়িয়ে রাহাতের চেহারা আরেকদিকে ঘুরিয়ে দিয়ে নূহা বলল, আপনার পন্ডিত পুত্রকে তো শাস্তি দিতেই হবে। বলাই তো হয়নি কয়েকদিন আগে সে কি কান্ড করেছে।
রাহাত হেসে বলল, কি কান্ড করেছে?
নূহা হেসে বলল, তুমি তো জানোই আমার সবচেয়ে অপছন্দের কাজগুলোর একটা হচ্ছে গাছের ফুল-পাতা ইত্যাদি ছেঁড়া। জারিফকেও আমি বুঝিয়েছি এমন কখনোই করা উচিত নয়। আর ওদের পাপার কাছ থেকে তো বৃক্ষ প্রেমের তালিম নিয়মিতই নেয় বাচ্চারা সবাই। সব মিলিয়ে গাছপালার প্রতি জারিফেরও অনেক মায়া। এখন ঘাসফুলের সময়। আমাদের বাসার পাশের পার্কটাকে মনেহয় যেন নানান ধরণের ঘাসফুলের রাজ্যে। আমার মতো আমার এক স্টুডেন্টও ঘাসফুল খুব পছন্দ করে। খুব ভালো একটা কাজ করেছিল সেই স্টুডেন্টটি। জারিফকে নিয়ে স্কুল থেকে ফেরার পথে পার্কের সামনে আসতেই ঘাসফুল দেখে সেই স্টুডেন্ট ও তার ভালো কাজের কথা মনে পড়লো। অনেকটা অজান্তেই একটা ঘাসফুল ছিঁড়ে ফেলেছিলাম ওর জন্য। আরেকটার দিকে হাত বাড়াতে যাচ্ছিলাম এই সময় জারিফ চিৎকার শুনতে পেলাম, মা তুমি এটা কি করলে? তুমি একটা ফুলকে হত্যা করলে? তুমি হত্যাকারী হয়ে গেলে।
হেসে ফেললো রাহাত স্বশব্দে। নূহাও হাসি মুখে বলল, এখন হাসি পেলেও ঐসময় জারিফের কথা শুনে আমারো ভীষণ মনখারাপ হয়ে গিয়েছিল। নিজেই অবাক হয়ে ভাবছিলাম এমন একটা কাজ কেন করলাম? কিন্তু জারিফের অস্থিরতার কারণে নিজের ভাবনাতে ফোকাস করা সম্ভব হচ্ছিলো না। ও হেলেদুলে থপথপ করে হাঁটছিল আর বলছিল, তুমি কি জানো না গাছের প্রাণ আছে? তাহলে কেন ছিঁড়লে ফুলটা? আহারে কিছুক্ষণ আগেও ফুলটা বেঁচে ছিল। কিন্তু এখন তোমার কারণে মারা গিয়েছে। মা তুমি কেমন করে পারলে ফুলটাকে মেরে ফেলতে? তুমি জানো ফুল হচ্ছে গাছের সন্তানের মতো। ঠিক আমি যেমন তোমার সন্তান। এরমধ্যে আবার দেখা হলো জারিফের এক ক্লাসমেটের সাথে। জারিফ ওর বন্ধুকে আমার হাতে ধরে থাকা ফুলটা দেখিয়ে বলল, দেখো আমার মা না এই ফুলটাকে মেরে ফেলেছে। সেই বাচ্চাটির অবাক দৃষ্টির সামনে আমার অপরাধবোধ আরো বেড়ে গেলো। কিন্তু নিজের সাপোর্টে বলার মতো কিছুই ছিল না তাই চুপ করে রইলাম। এরপর ঢুকলাম সুপার মার্কেটে। সেখানে ঢুকেও এক সেলসম্যানকে আমার হাতের ফুলটা দেখিয়ে বল, জানো আমার মা এই ফুলটাকে হত্যা করেছে। সেলসম্যান দিলো হাসি।
রাহাত হাসতে হাসতে বলল, তারপর?
নূহা হেসে বলল, তারপর আমি ওকে টেনে ধরে হাঁটতে হাঁটতে বললাম, কেন তুমি এমন করছো? ঠিকআছে মা নাহয় একটা ভুল করে ফেলেছি। তাই বলে কি তুমি সবাইকে ডেকে ডেকে বলবে? জারিফ জবাব দিলো, তুমিই তো বলেছো কেউ অন্যায় বা ভুল করলে তাকে শুধরে দিতে। তা না হলে একই ভুল বার বার করবে। তাই আমি তোমাকে শুধরে দিচ্ছি। তখন মনে পড়ল কারো ভুল এমন ঢাক পিটিয়ে শুধরে দিতে নেই একথাটা এখনো শেখানো হয়নি জারিফকে। তাই আর কিছু না বলে ঐসময় চুপ হয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু ভাবনারা মোটেই চুপ করে বসে রইলো না। তবে অনেক আত্নদহনের মাঝেও প্রাপ্তি খুঁজে পেয়েছিলাম একটা। ভুল করার সাথে সাথে ভুলের উপলব্ধি জাগিয়ে যাবার মতো আশেপাশে কেউ থাকাটা খুবই সৌভাগ্যের। বাবা-মামণি ও ভাইয়াদের গন্ডির অনেক বাইরে থাকি বলেই আমার ছোট ছোট ভুলগুলো অসংশোধিতই থেকে যাচ্ছিলো অনেক বছর ধরে। আলহামদুলিল্লাহ এখন একজন গুরু আছে আমার। যে সারাক্ষণই তৈরি থাকে আমার ভুল ধরা, শুধরে দেয়া ও শাসন করার জন্য। আলহামদুলিল্লাহ আলহামদুলিল্লাহ আলহামদুলিল্লাহ।
রাহাত হেসে বলল, আলহামদুলিল্লাহ। পুত্রকে যেহেতু গুরু মেনেই ফেলেছো তাহলে তো তার এই সমস্ত পান্ডিত্য সহ্য করতেই হবে এখন।
নূহা হেসে বলল, হুম, নো অপশন।
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে রাহাত বলল, তোমার মেহমানদের মনেহয় আসার সময় হয়ে গিয়েছে। আমরা পিতা-পুত্র তাহলে ব্যাগ গুছিয়ে বিদায় নেই এখন।
রাহাত আর জারিফ চলে যাবার পর রান্নাঘরের সবকিছু গুছিয়ে রুমে এসে বসতে বসতে না বসতেই ক্রমাগত ডোরবেল বেজেই চলছে শুনতে পেয়ে বুঝতে মোটেই কষ্ট হলো না দল বেঁধে তার এলোমেলো পাগলা স্বভাবের জুনিয়র ভগ্নী বাহিনী হাজির হয়েছে। হাসি মুখে দরজা খোলার জন্য রওনা হলো নূহা। দরজা খুলতেই হুড়মুড় করে ঘরে ঢুকলো আত্মজা, জুয়াইরিয়া, নায়লা, জুম্মি, জুনি, হাদিয়া আর সুমাইয়া। সম্মিলিত সালাম দিয়ে নূহার জবাবের অপেক্ষা না করেই দল বেঁধে সব রান্নাঘরের দিকে ছুট লাগালো। ঘটনা কি বোঝার জন্য নূহাও বোনদের পেছন পেছন রান্নাঘরের দরজায় পৌঁছে আত্মজা, নায়লা আর সুমাইয়ার বিজয় ধ্বনি শুনতে পেয়ে বুঝতে আর বাকি রইলো না তাদের জন্য খাবারের কি আয়োজন করেছে সেটা নিয়ে দুই গ্রুপ হয়ে গেস করার চেষ্টা করেছে। এবং আত্মজার দলের আন্দাজ সঠিক প্রমাণিত হয়েছে। নূহাকে দরজায় দেখে উল্লাসিত কন্ঠে নায়লা বলল, আপ্পা তুমি এত কিছু রান্না করেছো আমাদের জন্য? একা একা অনেক কষ্ট হয়েছে তোমার তাই না?
নূহা হেসে বলল, একা একা রান্না করেছি কে বললো তোদের? আমার হেল্পার সর্বক্ষণ সাথে সাথে ছিল আলহামদুলিল্লাহ।
হেসে ফেললো মেয়েরা সবাই। সুমাইয়া হাসতে হাসতে বলল, তোমার হেল্পারকে বলেছো তো তুমি যে দুদিনের জন্য আমাদের দ্বারা বুকড?
নূহা হেসে বলল, বলেছি বলেই তো হেল্পার সাহেব উনার পুত্রকে নিয়ে দুদিনের জন্য শ্বশুরবাড়িতে ঘরজামাই হতে গিয়েছেন। এখন তোরা সবাই যেয়ে ড্রইংরুমে বোস আমি সবার জন্য নাস্তা নিয়ে আসছি।
না আপ্পা তুমি এমনিতেই অনেক কষ্ট করেছো আমাদের জন্য। তুমি গিয়ে আরাম করে বোস আমরা নাস্তা রেডি করে নিয়ে আসছি।
জুয়াইরিয়ার কন্ঠে কন্ঠ মিলালো বাকি সবাইও। বোনদের কথা হাসি মুখে বিনা বাক্যে ব্যয়ে মেনে নিয়ে বারান্দার দিকে পা বাড়ালো নূহা। সাফিনকে এখনো বাগানে দাঁড়িয়ে থাকতে থেকে বলল, তুই এখনো এখানেই দাঁড়িয়ে আছিস?
সাফিন হেসে বলল, তোর ফিরনীর অপেক্ষা করছি। রাহাত ভাইয়া বাসায় আছেন দেখেই বুঝে নিয়েছিলাম ফিরনী অক্ষত আছে। বৌয়ের যে কোন অপকর্মের উপর পর্দা টেনে দেয়াতে রাহাত ভাইয়ার বিশ্ব রেকর্ড আছে।
নূহা হেসে ফেলে বলল, হাজবেন্ড ওয়াইফদের এমনই হতে হয়। পোশাক তো এজন্যই বলা হয়েছে একে অন্যের। যাতে সর্বদা সর্বাবস্থাতেই পরস্পরকে ঢেকে রাখতে পারে।
হুম, কিন্তু বাস্তবতা কেন জানি ভিন্ন কিছুরই প্রদর্শন করে। সেই তুলনায় প্রেমিক প্রেমিকাদের পরস্পরকে আড়াল করে রাখার প্রবণতা বেশি দেখা যায়। বিয়ে হওয়া মাত্রই কেন জানি ছেলেমেয়ে গুলো চিৎকার করে করে সবাইকে নিজ নিজ পার্টনারের দোষের চর্চা শুরু করে দেয়। দু’তিন জন ফ্রেন্ডকে এই দুরাবস্থায় ভুগতে দেখছি বর্তমানে। মজার ব্যাপার কি জানিস? বিয়ের আগে ওদের কাছে একে অন্যের দোষগুলোকেও সুইট আর কিউট লাগতো। আর এখন বিষের মতো লাগে পরস্পরের গুণগুলোকেও। এই ব্যাপারটা নিয়ে তোর সাথে কথা বলতে চেয়েছিলাম। এমন হয় কেন বলতো?
নূহা বলল, আমি প্রায়ই ভাবি কেন এমন হয়? কেন সুন্দর সম্পর্কগুলোর পরিণতি এতটা অসুন্দর হয়। আসলে যুদ্ধ জয়ের চেয়েও সেই অর্জিত বিজয়কে অক্ষুণ্ণ রাখাটা কঠিন। কোন সম্পর্ক কতটা ঝড়-ঝাপটা, ঝঞ্ঝা-বিক্ষুব্ধতা পেরিয়ে গন্তব্যের দেখা পেয়েছে তারচেয়েও কঠিন সেই গন্তব্যে স্থির থাকাটা। অতঃপর তাহারা সুখে শান্তিতে বাস করিতে লাগিলো। রিল লাইফের এমন হ্যাপি এন্ডিংটা মূলত রিয়েল লাইফের মোড়ক উন্মোচন। তাই হয়তো সমস্ত পরিবারের বিরুদ্ধে গিয়ে যে ছেলেটা মেয়েটাকে বিয়ে করেছিল। চার বছর যেতে না যেতে সমস্ত ভালোবাসা ভুলে দুই সন্তান মেয়েটির কোলে তুলে দিয়ে অন্য আরেকটি মেয়ের হাত ধরে তার জীবন থেকে বিদায় নিতে পারে। মনে প্রশ্ন জেগেই ওঠে এ কেমন ভালোবাসা? যারজন্য সবাইকে ছেড়ে দিয়েছিল একদিন! সেই তাকেই আবার কিভাবে ছেড়ে যেতে পারলো অন্য কারো জন্য? মুগ্ধকর ভালোবাসাময় সম্পর্কগুলো বছর ঘুরতে না ঘুরতেই তিক্ততায় কেন ভরে ওঠে?! প্রশ্নটা দীর্ঘশ্বাস হয়ে বেরিয়ে আসে বুকের গহীন থেকে। কেন যেই মানুষ দুজন সমস্ত দুনিয়া থেকে একে অন্যেকে আগলে রাখার অসাধারণ সুন্দর উদাহরণ উপস্থাপন করে, নিজেরাই আবার তা গুঁড়িয়ে দেয়? একদা যার জন্য শত আঘাত হাসি মুখে সইতে প্রস্তুত ছিল। তাকে কিভাবে আঘাত করে নিজেই?! কিভাবে কাঁদায় সেই মানুষটাকে যার কান্নার চেয়ে অসহনীয় কিছুই ছিল না তার কাছে? যার দিকে ছুটে আসা কারো নেতিবাচক কোন সম্বোধনে ফুসে উঠতে দ্বিধা করতো না, তাকেই কিভাবে হেয় করে প্রকাশ্যে অন্যের সম্মুখে?!
সেটাই তো প্রশ্ন, কিভাবে করে?
আসলে যে কোন সম্পর্ক ই গড়ে তোলার চেয়ে টিকিয়ে রাখাটা কঠিন। যতটা সাধনা, অধ্যবসায় সম্পর্ক গড়ার ক্ষেত্রে প্রয়োজন হয়, তারচেয়ে বেশি সাধনার প্রয়োজন সেই সম্পর্কে বিদ্যমান হক সমূহ আদায় করাটা। কিন্তু বেশির ভাগ সময়ই একটা সম্পর্ক তৈরি হলে যাবার পর মানুষ সেটাকে ফর গ্রান্টেড ধরে নেয়। যারফলে ধীরে ধীরে কমতে শুরু করে আদর, কদর। সম্পর্কটি কখনো বিশুদ্ধ বাতাসের অভাবে ছটফট করে, কখনো বা পানির অভাবে তৃষ্ণার্ত প্রহর কাটায়। এরপর একটা সময় এখানেও কার্যকর হয়ে ওঠে মানুষের স্বভাবজাত অভ্যস্ততা। অক্সিজেন ছাড়াও বেঁচে থাকে প্রাণহীন সম্পর্ক। ভুলে যায় পানির স্বাদ, ধীরে ধীরে হয়তো প্রয়োজনীয়তা! সম্পর্কের বদলে যাওয়া এই রুপ বড়ই ভয়ংকর মনেহয়! তবুও কেন জানি না ক্ষুদ্র জীবনের ক্ষুদ্র অভিজ্ঞতাতে বার বার দেখতে হয় অমৃতের এমন বিষে রুপান্তর। মূলত, যত্নের অভাবেই বদলে যায় সুন্দর সম্পর্কগুলো। আমরা কাছের মানুষদের ব্যাপারে, আপনজনদের ব্যাপারে মোটেই যত্নশীল নই। বাইরের কারো কাছে নিজেকে সুন্দর ভাবে উপস্থাপন করার ব্যাপারে আমাদের কত সাধনা থাকে, পরিশ্রম থাকে কিন্তু পরিবারের কারো কাছে নিজেকে আরো উত্তম রূপে উপস্থাপনের জন্য আমরা খুব কমই হোমওয়ার্ক করি। উল্টো আরো বলি, বাইরে কত শ্রদ্ধা, সম্মান করে মানুষ আমাকে। ঘরের মানুষের কাছেই কোন মর্যাদা পেলাম না। আমার কোন মূল্যই নেই কারো কাছে। কিন্তু একবারও নিজেকে প্রশ্ন করে দেখে না, নিজেকে প্রিয় কারো অমূল্য সম্পদে রূপান্তরিত করার জন্য সে কি আসলেই কি করেছে?
সাফিন বলল, আসলেই তাই। আচ্ছা প্রিয় মানুষগুলোর কাছে স্পেশ্যাল হবার জন্য কি কি করা উচিত আমাদের?
নূহা হেসে বলল, কারো মনের গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করার জন্য তার জীবনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখাটা অবশ্যই জরুরি। তবে গুরুত্বপূর্ণ অবদান যে শুধু বিশাল কিছু করার মাধ্যমেই রাখতে হয় এমনটা কিন্তু নয়। এমনটাও নয় যে সাংঘাতিক কোন ত্যাগের বিনিময়েই মেলে কারো হৃদয়ে স্পেশাল মর্যাদা। মানুষ মূলত অন্যের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে ছোট্ট ছোট্ট কথা, কাজ ও আচরণের দ্বারা। যেমন, “কখনো মেনে নিয়ে, কখনো বা মানিয়ে চলে, কখনো নিঃশব্দ সহচর, কখনো অভিনব কৌশলে! কখনো হয়ে প্রেরণা, কখনো করে সমালোচনা, কখনো শুধরে দিয়ে ভুল উন্মুক্ত করা সম্ভাবনা! হয়ে বিশ্বাস মনেতে জাগিয়ে যাওয়া আশ্বাস, উদারতা আকাশ ছোঁয়া, সজীবতার আবাস! প্রকাশ করতে নিজের মতামত, না দিয়ে অন্যকে ক্ষত, বুঝে নিয়ে অবগুণ্ঠিত চাওয়া, জানিয়ে দেয়া নিজ ভিন্ন মত!” তবে কারো কাছে স্পেশাল হবার জন্য ভালোবাসার চেয়ে স্পেশাল আর কিই বা হতে পারে? আবেগের প্রকাশ দ্বারে শুধু একটা ভালোবাসার ফিল্টার লাগিয়ে নিতে হয়। তাহলে কারো শাসন, অভিযোগ, রাগ, বকে দেয়া, সমালোচনা সবকিছুর মাঝেই দেখা মেলে ভালোবাসার। আর যার প্রতিটা আবেগ ভিন্ন ভিন্ন রুপে শুনিয়ে যায় ভালোবাসার কাব্য, সে স্পেশাল কেউ হয়ে যায় নিজেরও অজান্তেই।
সাফিন হেসে বলল, নোট করে রাখলাম সব কথা। ইনশাআল্লাহ ফ্রেন্ডদেরকে বুঝিয়ে বলবো।
এখন তাহলে উপরে আয় ফিরনী নিয়ে যা।
সাফিন চলতে শুরু করে বলল, তুই যেয়ে দরজা খোল। দেখবি আমি হাত বাড়িয়ে তোর সম্মুখে দন্ডায়মান। মিষ্টান্নের নাম শুনলেই সুপারম্যান পাওয়ার চলে আসে আমার মধ্যে।
হেসে ফেললো নূহা। এরপর দরজা খোলার জন্য ছুট লাগালো। সুপারম্যান ভাইকে দেখিয়ে দিতে হবে সেও যে সুপারওম্যান।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন