সোমবার, ৩ অক্টোবর, ২০১৬

ভালোবাসার সুতোয় গাঁথি সম্পর্কের মোতি...৪



আমিও চলে এসেছি আপ্পা চা বানানো শেখার জন্য। 
বিকেলের নাস্তা দেবার পর সবার জন্য চা বানাতে এসেছিল নূহা। কথা শুনে রান্নাঘরের দরজার দিকে তাকিয়ে হাসি মুখে সুমাইয়াকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে নূহা হেসে বলল, ভেতরে এসো। 
ভেতরে ঢুকে সুমাইয়া বলল, চা বানানোর সাথে সাথে আমাকে আরেকটা জিনিসও শিখিয়ে দিতে হবে।
নূহা হেসে বলল, কি জিনিস?
নিজের ভুলগুলোকে খুব সহজ ও স্বাভাবিক ভাবে মেনে নেয়াটা। নিজের দোষ, অন্যায়গুলো অকপটে স্বীকার করে নেয়া। শুধু আমি না আপ্পা আমাদের পরিবারের প্রতিটি সদস্যরই এই একটাই সমস্যা। আমরা কেউ কারো কাছে হার মানতে চাই না। আব্বু আম্মুর মধ্যে এই সমস্যাটা খুবই জোরালো ভাবে আছে। আমাদের ভাইবোনদের মধ্যেও। একটা সময় আমি বুঝতাম না কিন্তু এখন বুঝি অনেক কিছুই করি, বলি যা আসলে ঠিক না। কিন্তু কেন জানি এটা সবার সামনে মেনে নিতে পারিনা। আগে তো নিজের কাছেও মেনে নিতে পারতাম না। আলহামদুলিল্লাহ এখন অন্তত নিজের ভুলটা বুঝতে পারি। এই অবস্থা থেকে কিভাবে মুক্তি পেতে পারি সেটা বলে দিতে হবে আমাকে।
সত্যিই এটা অনেক বড় একটা সমস্যা। নিজেকে অন্যের কাছে সর্বদা সঠিক রাখতে চাওয়ার পেছনে মূলত ইগো কাজ করে। আর সম্পর্কের বন্ধনের চেয়ে যখন ইগো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে মানুষের কাছে তখন ভালোবাসার শক্তি দুর্বল হয়ে যায়। যারফলে, খুব ভালোবাসার দাবী করে যাকে তাকেও মানুষ আঘাত করতে পারে নির্দ্বিধায়।
সুমাইয়া বলল, আমিও আজকাল এমনটাই মনেহ্য় আপ্পা। সেজন্যই এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে চাই।
নূহা হেসে বলল, মুখ আর মুখোশের যে পার্থক্যের কথাটা বলা হয় সেটা মূলত বলা হয় অন্যদের সাথে আচরণের পরিপ্রেক্ষিতে। কিন্তু মুখ ও মুখোশের এই যে আবডাল এটা কিন্তু ব্যক্তির নিজের সাথেও বিদ্যমান থাকে অনেক ক্ষেত্রেই। যেমন নিজের কোন দোষ কিংবা বদভ্যাস জানা থাকার পরেও জোর করে অজ্ঞাত সেজে থাকা। কিছুতেই নিজের কোন ঘাটতিকে স্বীকার করতে না চাওয়া। নিজের সাথে এই যে আড়াল, এই যে লুকোচুরি এরফলেও মনের ঘরে বাসা বাঁধে নানান ধরণের মানসিক অস্থিরতা, দোটানা, দ্বিধা-দ্বন্দ্ব,দোদুল্যমনতার। মুখ আর মুখোশের ব্যবধান ঘুচিয়ে কিভাবে একজন ব্যক্তি সত্যের মুখোমুখি দাঁড়াতে পারে সেই সম্পর্কে জানতে গিয়েই জেনেছিলাম সেলফ হিপনোটিজম পদ্ধতি সম্বন্ধে। বিষণ্ণতার মেঘকে উড়িয়ে মনের বিষাদ কাটিয়ে বিশ্বাসের সূর্য থেকে নিঃসৃত আশার কিরণে কিভাবে নতুন করে সম্মুখে এগিয়ে চলার উৎসাহ পাওয়া যায় সেই ফমূর্লাই হচ্ছে সেলফ হিপনোটিজম। মূলত আমাদের হতাশা, নিরাশা, দুরাশা, হাল ছেড়ে দেয়া, নিস্তেজ হয়ে যাওয়া ইত্যাদি নেতিবাচক আচরণ সমূহের আসল কারণ আমরা নিজেদের নিয়ে একদমই ভাবিনা। অথচ নিজেকে নিয়ে চিন্তা করাটা খুব বেশি জরুরী। আত্মবিশ্লেষণ, আত্নপর্যালোচনা, আত্নসমালোচনা ব্যক্তিকে শুধু যে উন্নতির দিকে ধাবিত হতেই সহায়তা করে তাই নয়। ব্যক্তির সামনে উন্মোচন করে তার নিজেকে, তার আপনার আমিকে। আমরা প্রায় সময়ই নিজের কোন কথা-কাজ বা আচরণের পেছনে কোন রিজন বা লজিক খুঁজে পাইনা। অন্যদের সাথে সাথে নিজেরাও হয়রান, পেরেশান হই নিজের কর্মকান্ডে। এর কারণ নিজের সম্পর্কে অজ্ঞতা। নিজের চিন্তা ও কর্মের উপর নিয়ন্ত্রণের জন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন নিজের সম্পর্কে জানা। আবার জানতে হলে নিজেকে বুঝতে হবে এবং বুঝতে হলে নিজেকে নিয়ে ভাবতে হবে। কেননা নিজেকে নিয়ে ভাবলেই নিজের মুখোমুখি হওয়া যায়।
জ্বি আপ্পা। যখন থেকে নিজেকে নিয়ে খুব গুরুত্বের সাথে ভাবতে শুরু করেছি তখন থেকেই মূলত নিজের এই সমস্ত দোষগুলো কিছুটা হলেও বুঝতে শুরু করেছি।
সেজন্যই আমি সবসময়ই তোমাদেরকে বলি নিজেকে সময় দেবার কথা। নিজের মাঝে নিজেকে খুঁজে ফেরার কথা। আপনও আঁধার কোথায়, আলো কোথায় সেই জ্ঞান রাখার কথা। আসলে প্রত্যেক মানুষের মধ্যেই কিছু ভালো এবং কিছু মন্দ দিক আছে। নিজের উত্তম গুণাবলী সম্পর্কে ভাবনা মানুষকে আনন্দিত করে, উৎসাহিত করে। অপরদিকে নিজের মধ্যে বিদ্যমান দোষ-ত্রুটি-ব্যর্থতা ইত্যাদি নিয়ে ভাবলে নিজেকে সংশোধন করার ইচ্ছে জাগ্রত হয়। প্রতিটা মানুষের মধ্যেই নিজেকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাবার শক্তি আছে। এক টুকরো আলো আছে মনের কোনে ঘোর আঁধারে পথ প্রদর্শনের জন্য। তেমনি আছে হাল ছেড়ে দিয়ে বসে যাবার মতো দুর্বলতা, আছে আশার টিমটিমে বাতিটাকে পুরোপুরি নিভিয়ে দেবার মতো অন্ধকারাচ্ছন্ন বাতাস। তাই অবশ্যই জানা থাকা উচিত কোথায় নিজের শক্তি আর কোথায় নিজের দুর্বলতা ।নিজের সম্পর্কে যথাযথ ধারণা থাকলে মানুষ থেকে উত্তম মানুষ হবার সফর খুব সহজেই পাড়ি দেয়া সম্ভব হয়। এজন্য দরকার নিজের কাছে নিজের মুখোশ উন্মোচন করে, নিজেই নিজের আয়না হবার। তবে বিষয়টা খানিকটা কঠিন বৈকি! কেননা আমাদের মনের ভেতরটাকে বলা যায় হাজারো চিন্তা-ভাবনার এক বিশাল কারখানা। যেখানে চেতন, অবচেতন, অচেতন সর্বাবস্থাতেই সর্বক্ষণই উৎপন্ন হতে থাকে নানামুখী চিন্তার স্রোত এবং প্রবাহিত হয় নানান দিকে। আবেগের মহাবিশৃংখলা, প্রতিকুল অবস্থা-অবস্থান, পরিবেশ-পরিস্থিতি, আত্মনিয়ন্ত্রণের অভাবে চারিত্রিক নানান দূর্বলতা অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায় সুন্দর জীবন গড়ার পথে। ইগোর গোলকধাঁধা, স্বার্থপরতার চোরাবালি, প্রতিহিংসার দহন, পরশ্রীকাতরতার গুপ্তঘাতক ইত্যাদি ঘুণপোকার মতে কুড়ে কুড়ে খায় মনের কোমলতা, সরলতা, উচ্ছ্বাস, বিশ্বাস, আশা, ভালোবাসাকে। মানুষ হয়ে যেতে থাকে সুন্দর আবেগ বিবর্জিত যন্ত্র এবং অসুন্দর আবেগ চালিত অনুভূতিহীন প্রাণী। নিজেই নিজের ধরা ছোঁয়ার বাইরের কেউ। নিজেকে খুঁজে পেতে, ছুঁয়ে দিতে হিপনোটিক সাজেশন পালন করতে পারে সহায়ক ভূমিকা।
কিভাবে করতে হয় সেলফ হিপনোটিজম?
নূহা হেসে বলল, বলবো। তবে তারআগে মজার একটা ঘটনা বলি তোমাকে। আমার এক ফ্রেন্ড একদিন নীচু গলায় লাজুক কন্ঠে বলল, আমার একটা বিরাট সমস্যা আছে। কিভাবে যে দূর করবো ভেবে পাচ্ছি না। সমস্যাটা কি জানতে চাইলে সে বললো, গল্প-উপন্যাস, নাটক-মুভি যাই কিছু পড়তে বা দেখতে যায় ইমোশনাল দৃশ্যপটে কিছুতেই অশ্রু সংবরণ করতে পারে না। এটা নিয়ে প্রায়ই লজ্জিত হতে হয় পরিজন ও বন্ধুমহলে। ইমোশনাল দৃশ্য এলে সবাই টিভির স্ক্রিনের বদলে তার দিকে তাকিয়ে থাকে বিনোদন নেবার উদ্দেশ্যে। ফ্রেন্ডের গুরুতর এই সমস্যার কথা শুনে হাসি চাপতে বেশ কষ্ট হয়েছিল। কেননা আমি নিজেও সেই ফ্রেন্ডের কথায় কথায় কেঁদে অস্থির হয়ে যাওয়াটা দেখে বেশ মজা পেতাম। যদিও এমনটা কম-বেশি প্রায় সব মানুষের সাথেই হয়। ইমোশনাল কথা পড়ে, দৃশ্য দেখে কাল্পনিক জানা থাকার পরেও আমাদের বুকের ভেতরটা ভার হয়ে আসে, চোখ ভিজে ওঠে।
সুমাইয়া হেসে বলল, হ্যা এটা তো আমারও হয়। গল্প উপন্যাস পড়ার সময় ইমোশনাল কিছু থাকলে আমার চোখের নল অটোমেটিক অন হয়ে যায়।
নূহা হেসে বলল, কখনো কি ভেবে দেখেছো এর কারণ কি? কেন এমনটা হয় যেখানে স্পষ্ট জানাই থাকে আমি যা দেখছি বা পড়ছি তা মোটেই বাস্তব কিছু নয়! এর কারণ আমাদের নার্ভাস সিস্টেম কল্পনা ও বাস্তবতার মধ্যে পার্থক্য করতে পারে না। বাস্তব কোন ঘটনার ক্ষেত্রে আমাদের ব্রেইনে যে ওয়েভ তৈরি করে, কাল্পনিক ঘটনার ক্ষেত্রেও একই ওয়েভ তৈরি হয়। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় গল্প-উপন্যাস, নাটক-সিনেমার কথা। যেখানে পরিষ্কার জানা থাকে এটা অভিনয় কিন্তু তারপরও আমরা সেই অভিনীত দৃশ্যের পরিপ্রেক্ষিতে কখনো হাসি, কখনো কাঁদি। এমনকি কারো প্রতি হই ঈর্ষানীত্ব, কারো প্রতি প্রতিশোধপরায়ন। নায়ক যখন ভিলেনকে হারিয়ে দেয় আমরা ছোট শিশুর মতোই উচ্ছ্বাসিত হই। নায়ক-নায়িকার বিচ্ছেদে হই ভারাক্রান্ত, তাদের মিলনে হই আবেগঘন, চোখের কোণে চিকচিক করে ওঠে আনন্দ্রাশ্রু। চিন্তা করলে এই বিষয়গুলো সত্যিই বিস্ময় জাগায় মনে। এত বুদ্ধিমান প্রাণী হবার পরেও মানুষ কেন কল্পনার স্রোতে ভেসে যায়? কেন পারে না বাস্তবতার সাথে প্রভেদ নির্ণয় করতে?!
কেন পারে না আপ্পা?
কারণ আগেই বলেছি আমাদের নার্ভাস সিস্টেম কল্পনা ও বাস্তবতার মধ্যে পার্থক্য করতে পারে না। আমরা যদিও বা কোন গল্পের বই পড়ছি কিংবা অভিনীত দৃশ্য দেখছি। কিন্তু আমাদের নার্ভাস সিস্টেম মোটেই সেটাকে অভিনয় বা গল্প মনে করছে না। সে এটাকে বাস্তব ধরে নিচ্ছে এবং আমাদেরকে রিয়েল ইমোশন সাপ্লাই দিচ্ছে। যারফলে আমরা ঠিক তাই করি যা ঘটনাটা বাস্তবে ঘটলে করতাম। আমাদের নার্ভাস সিস্টেমের এই যে বৈশিষ্ট্য এটা কিন্তু আমাদের জন্য বিরাট একটা প্রাপ্তি। নিজেকে লক্ষ্যানুযায়ী পরিচালিত করার পথে বিরাট এক অস্ত্রও বলা যায়। যখন নেতিবাচকতায় ছেয়ে যায় আমাদের জীবন। এবং তার প্রভাবে প্রভানিত্ব হই আমরা। বিষণ্ণতা, হতাশা ঘিরে ধরতে চায় আমাদের মনকে। তখন আমরা চাইলেই পারি আমাদের আমাদের নার্ভাস সিস্টেম থেকে পজেটিভ ফিডব্যাক আদায় করে নিয়ে আশার দিয়া জ্বালাতে।
সেটা কিভাবে?
বলছি তবে তারআগে আরেকবার মনে করে দেই শব্দের শক্তির কথা। শব্দে লুকায়িত প্রাণের অস্তিত্বের কথা। অনেকেই জানেন না 'শব্দে লুকায়িত আছে শক্তি, শব্দ দিতে পারে মুক্তি, শব্দ জাগায় ভক্তি, শব্দ আনে তৃপ্তি। শব্দ করে হতাশ, শব্দই সুবাসিত বাতাস, শব্দ ছোঁয়ায় আকাশ, শব্দে গভীর দীর্ঘশ্বাস'। শব্দ বা কথা খুবই শক্তিশালী। শব্দের আছে ভয়াবহ সৃষ্টিশীল ক্ষমতা। শব্দ কিন্তু শুধু কোন কিছু উপস্থাপনই করে না, একই সাথে শব্দ সেইসব কিছুকে মনে স্থাপনও করে, মস্তিষ্কে নির্মাণও করে। উদাহরণ স্বরূপ খাবারের কথা বলা যায়। কেউ যদি আমাদের সামনে আমাদের খুব পছন্দনীয় কোন খাবারের কথা বলে, আমাদের চোখের সামনে সেই খাবারটার ইমেজ ভেসে ওঠে। আবার টক জাতীয় কোন খাবারের নাম শুনলেই মুখে লালা চলে আসে। কারো মুখে তার বেদনার কথা শুনলেই আমাদের মনে সহানুভূতি জেগে ওঠে। এইসব কিছুই প্রমাণ করে শব্দ শুধু কোন কিছুর বিবরণই দেয় না বরং সেই বস্তুর ইমেজ তৈরি করারও ক্ষমতা রাখে। সেলফ হিপনোটিজম পদ্ধতিতে শব্দের এই ইতিবাচক ক্ষমতাটিই ব্যবহৃত হয়। আমাদের নার্ভাস সিস্টেম কল্পনা ও বাস্তবতার পার্থক্য বোঝে না এবং আমাদের শব্দের আছে যে কোন কিছুর ইমেজ সৃষ্টির ক্ষমতা। এ যেন একেবারে সোনায় সোহাগা, মানিকজোড়, অমূল্য দুই রতন। অবুঝ শিশুর মতো নার্ভাস সিস্টেম আর কৌশলী পিতার মতো শব্দভান্ডার। উদাহরণ স্বরূপ তোমাদের জাওয়াদ ভাইজানের সাথে বাচ্চাদের কোন একটা কথোপকথন চিন্তা করে দেখতে পারো।
সুমাইয়া হেসে ফেললে নূহাও হাসতে হাসতে বলল, শব্দের ক্ষমতাকে ব্যক্তির মানসিক অবস্থা পরিবর্তনের জাদুর কাঠির সাথে তুলনা করা হয়। গবেষণাতেও দেখা গিয়েছে সাফল্যের অনুভূতি মানুষের সফলতার পথে চলাকে ত্বরান্বিত করে। শব্দের প্রয়োগে মানুষ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে তার ভেতরে প্রবাহিত আবেগের ধারাকে। নেতিবাচক পরিস্থিতিতেও তৈরি করতে পারে ইতিবাচক আবহ। অনেক আশা, উচ্ছ্বাস নিয়ে জীবনকে ঘিরে নানান রঙের স্বপ্ন সাজাই আমরা। কিন্তু খুব কম সময়ই জীবন আমাদের সামনে সেভাবে হাজির হয়, যেভাবে আমরা পেতে চেয়েছিলাম, পরিকল্পনা করেছিলাম। যারফলে আশাভঙ্গ হয় আমাদের, জীবনের ঘাত-প্রতিঘাতে আমরা হই বিপর্যস্ত, দিশেহারা, হারিয়ে ফেলি জীবনের স্বাভাবিকত্ব। জীবনের এমন হতাশা ঘেরা মুহুর্তগুলোতে নির্ভরযোগ্য একটা আশ্রয় খুঁজে ফিরি। যে কোনো একটা অবলম্বন যাকে আঁকড়ে জীবন ফিরে পাওয়া যাবে জীবনের স্বাভাবিক গতি। এমন কিছু বা এমন কেউ যার সম্মুখে খুলে দেয়া যাবে মনের বদ্ধ ঘরের দরজা, জানালা। যে শীতের সকালের সোনা রোদ হয়ে উঁকি দেবে মনের কুয়াশাচ্ছন্ন কোণে। যার হাত ধরে হাজির হবে সুবাসিত বিশুদ্ধ বাতাস। বুকের মাঝে দলা পাকানো না বলা কথাগুলো যাকে বলে নিজেকে করে নেয়া যাবে নির্ভার। যে মনে জ্বালাবে আশার নতুন দিয়া। যার প্রভাবে নিজেকে আর মনে হবে না ভীষণ অসহায়। একটা স্বস্থিকর আশ্রয় আসলে মানুষের খুব বেশি প্রয়োজন। যার ছায়ায় বসলে মন উপলব্ধি করবে, না এখনো নিঃশেষ হয়ে যাইনি আমি। এখনো বাকি আছে অনেককিছুই নতুন করে শুরু করার মতো।
সুমাইয়া হেসে বলল, আলহামদুলিল্লাহ আমাদের আপ্পার ছায়ায় আমিও এমনটাই ফিল করি।
নূহা হেসে বলল, আলহামদুলিল্লাহ। তবে এই যে মনে নতুন করে বিশ্বাস জন্মানো মূলত এটিই হচ্ছে হিপনোটিজম। হতাশার বাদল সরিয়ে মনের আকাশে আশ্বাসের সূর্যকিরণ উঁকি দেয়াটাই হিপনোটিজম। মজার ব্যাপার হচ্ছে, হিপনোসিস যে শুধুমাত্র থেরাপীস্টরাই করতে পারবে এমন কোন নিয়ম নেই। যে কেউ চাইলে নিজেই নিজেকে হিপনোটিক সাজেশন দিতে পারে। এটাকে অটো সাজেশনও বলা হয়ে থাকে। যেহেতু নিজেই এখানে নিজের থেরাপীস্ট। আরেকটা বিষয় হচ্ছে, হিলিং পাওয়ার সবার ভেতরেই আছে। আমাদের কথা যদি অন্য কারো জন্য স্বস্থির উৎস হতে পারে, তাহলে নিজের জন্য কেন নয়? অন্যদেরকে যদি আমরা তাদের নেতিবাচক পরিবেশ-পরিস্থিতির বিরুদ্ধে লড়ার জন্য উৎসাহ দিতে পারি, প্রেরণা যোগাতে পারি। তাহলে নিজেকে কেন পারবো না? চেষ্টা করলে অবশ্যই পারবো ইনশাআল্লাহ। তবে এজন্য মন থেকে সমস্ত নেতিবাচক চিন্তা-ভাবনা ঝেড়ে ফেলে নিজেকে বোঝাতে হবে। ঠিক যেমন করে আমরা অবুঝ কোনো শিশুকে বোঝাই ঠিক সেভাবে। এটিই হচ্ছে সেলফ হিপনোটিজম। যেমন, কোন পরিস্থিরিতে নিজের মেজাজকে নিয়ন্ত্রণ করাটা হয়তো খুব কঠিন আমার জন্য। আমাকে যা করতে হবে তা হচ্ছে যত্ন ও ধৈর্য্য সহকারে নিজেকে বোঝাতে হবে ব্যাপারটা মোটেই কঠিন নয় তোমার জন্য। তুমি চাইলেই পারো শান্ত ভাবে ঐ পরিস্থিতিটাকে মোকাবেলা করতে। এভাবে ক্রমাগত বলতে বলতে একটা সময় আমাদের নার্ভাস সিস্টেম এই কথাটিকেই সত্যি বলে ধরে নেবে। এবং ঐ পরিস্থিতিতে উত্তেজিত না হয়ে শান্ত থাকবে।
সুমাইয়া অবাক কন্ঠে বলল, সত্যিই কি এমনটা সম্ভব? আমি নিজেই নিজের জাদুকর হতে পারবো?
নূহা হেসে বলল, চেষ্টা করলে অবশ্যই পারবে ইনশাআল্লাহ। তাছাড়া হিপনোটিক সাজেশন ব্যাপারটা কিন্তু মোটেই বিস্ময়কর বা অস্বাভাবিক কিছু নয়। বরং এটি আমাদের নিত্যজীবনের সাথে জড়িয়ে আছে। যেমন, কোন ব্যর্থতায় হয়তো তুমি ভেঙে পেরেছো। আপনজনদের কেউ যখন পাশে বসে মাথায় বা পিঠে হাত বুলিয়ে আশা জাগানিয়া কয়েকটা শব্দ বলে, আরেকবার চেষ্টা করে দেখতে বলে, তখন হতাশার আঁধারে এক বিন্দু আলো নিয়ে হাজির হয় ছোট্ট একটা জোনাকি। আশা জেগে ওঠে আবারো। ইচ্ছে জাগে আরেকবার চেষ্টা করে দেখার। খুব প্রিয় কারো সাথে হয়তো মানসিক দ্বন্দ্বটা এমন এক পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছে সেখান থেকে শুধু সমাপ্তির দরজাটাই দেখা যাচ্ছে। তখন কাছের কেউ যখন বদ্ধ কোন একটা দরজা খানিকটা খুলে দিয়ে বলেন, সমাপ্তির আগে এই পথটা ধরে আরেকবার হেঁটে দেখো। আপনজন যখন বলছেন দেখিই না খানিকটা পথ চলে। এমনও তো হতে পারে হয়তো সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। এমন চিন্তা থেকে ব্যক্তি নিজেকে বোঝাতে শুরু করে এবং আরেকবার চেষ্টা করে। এই যে নিরাশার আঁধারে বিশ্বাসের দিয়া জ্বলে ওঠা, ছেড়ে দেয়া হালকে আবারো কাঁধে তুলে নেয়ার মতো মানসিক জোর ফিরে পাওয়া এসবই হিপনোটিজমের অংশ। আবার অনেক পরিবারেই দেখা যায় একজন সদস্য এমন থাকেন যাকে এক বাক্যে বলা যায়, হেড অব দ্য ফ্যামিলি। পরিবারের সর্বময় নিয়ন্ত্রণ যার হাতে থাকে। যারকথা সবাই শোনেন, মেনে চলেন। যে কোন বিপদ-আপদ-সমস্যার সময় পরামর্শ নেবার জন্য সবাই তার কাছেই ছুটে যায়। এবং দৃঢ় বিশ্বাস ও আস্থা থাকে তিনি যা বলবেন তা অবশ্যই কল্ল্যাণকর কিছুই হবে। এই যে নিজের কথা, কাজ ও আচরণের দ্বারা সবার মধ্যমণিতে পরিণত হওয়া এটা মূলত সেই ব্যক্তির হিপনোটিক পারসোনালিটির জন্যই। তাঁর বিচার-বিবেচনা, বুদ্ধি, আন্তরিকতা, অভিজ্ঞতা এবং বোঝানোর ক্ষমতাই তাকে সবার মনে বিশেষ একটা স্থানে অধিষ্ঠিত করে। ঠিক একই ভাবে পুনঃপুনঃ চেষ্টার দ্বারা অধিষ্ঠিত হওয়া যায় নিজের কাছেও। মূলত পরিবশ-পরিস্থিতি, অবস্থা ও অবস্থান অনুযায়ী নিজের পার্সোনালিটির প্যাটার্নের পরিবর্তন ঘটনোটাই সেলফ হিপনোটিজমের মূল কথা। বুঝতে পেরেছো?
সুমাইয়া হেসে বলল, জ্বি আপ্পা। তারমানে আমাকে এখন যা করতে হবে তা হচ্ছে, নিজেই নিজেকে বলতে হবে আমি আমার ভুলগুলোকে মেনে নিতে পারি। নিজের ভুল মেনে নেবার মাঝে হেরে যাবার কিছু নেই। বরং নিজের ভুলকে মেনে নিলেই আত্মোন্নয়নের পথে এগিয়ে চলাটা দ্রুততর হয়।
নূহা হেসে বলল, মাশাআল্লাহ এই তো বুঝে ফেলেছো। এখন তাহলে নেক্সড লেসনে যাই চলো। চা বানানোতে।
সুমাইয়া হেসে বলল, জ্বি আপ্পা।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন